ইসরায়েলি হামলায় নিহত ইরানি সেনাপ্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি

ইরানের রাজধানী তেহরান এবং আশপাশের এলাকায় অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এই নজিরবিহীন হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান (চিফ অব স্টাফ) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আইআরআইএনএন নিশ্চিত করেছে যে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ইসরায়েলের চালানো বিমান হামলায় জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি নিহত হন। এর আগে একই ধরনের হামলায় জেনারেল হোসেইন সালামির মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল একাধিক ইরানি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম।

বিশ্লেষকদের মতে, এই দুই শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার প্রাণহানি ইরানের সামরিক কাঠামোতে এক বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তারা বলছেন, এটি ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানের সামরিক নেতৃত্ব ও কৌশলগত অবকাঠামোর ওপর এক সরাসরি এবং মারাত্মক আঘাত।

হামলার সময় ও প্রেক্ষাপট

ইসরায়েল জানিয়েছে, “নেশন অব লায়ন্স” নামের এই অভিযানটি ছিল একটি পূর্ব পরিকল্পিত ও প্রতিরোধমূলক হামলা, যার লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং সামরিক সক্ষমতা। টাইমস অব ইসরায়েলের বরাতে জানা যায়, ইরান থেকে আসা তাৎক্ষণিক হুমকির জবাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং সামরিক ঘাঁটিগুলোর বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত হেনেছি। যতক্ষণ না আমাদের মিশন সফল হয়, ততক্ষণ এই অভিযান চলবে।”

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, রাজধানী তেহরানে অবস্থিত ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের সদর দপ্তরে হামলা হয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ওই এলাকায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা গেছে এবং আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে।

এছাড়া, ইরানের কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনাও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে সাময়িকভাবে সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

নিহতদের পরিচয় ও গুরুত্ব

জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি ছিলেন ইরানি সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, যিনি সামরিক কৌশল ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। অপরদিকে, জেনারেল হোসেইন সালামি ছিলেন IRGC-এর কমান্ডার ইন চিফ এবং দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এই দুইজনের মৃত্যু ইরানের সামরিক সিদ্ধান্তগ্রহণের ধারাকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্র এই হামলায় তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, “এই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়। আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হলো মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।” তিনি আরও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্বার্থ বা সামরিক স্থাপনায় হামলা হলে, তার জবাব ভয়াবহ হবে।”

জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয় পক্ষই সংযম ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, এই উত্তেজনা যেন আর বিস্তৃত না হয় এবং দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে ফিরতে হবে।

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির আশঙ্কা

ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদেহ সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “পারমাণবিক আলোচনা ব্যর্থ হলে এবং যুদ্ধ শুরু হলে, আমাদের প্রথম লক্ষ্য হবে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মার্কিন ঘাঁটিগুলো।” এই বক্তব্যের পরপরই হামলার ঘটনা ঘটায়, বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে।

ইসরায়েলি হামলায় ইরানের দুই শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার মৃত্যু মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুর নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে, এটি একটি বিস্তৃত সংঘর্ষে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন প্রধান দায়িত্ব—এই উত্তেজনা নিরসনে কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ।