করোনায় হঠাৎ কল বেড়েছে ১৬২৬৩ নম্বরে: কিট ও টিকা সংকটে প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন

দেশে আবারও করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। সম্প্রতি ১৬২৬৩ নম্বরে করোনাবিষয়ক কলের সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্য বাতায়নের এই নম্বরে সাধারণভাবে যেকোনো স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত পরামর্শ পাওয়া গেলেও গত কয়েকদিনে এর কলের ধরন উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার দেশে করোনায় একজনের মৃত্যুর পর থেকে পরিস্থিতি নজরে আসে। যদিও সংক্রমণ এখনো ব্যাপক নয়, তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা এটিকে সম্ভাব্য নতুন ঢেউয়ের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন।

স্বাস্থ্য বাতায়নে করোনাবিষয়ক কল বাড়ছে

স্বাস্থ্য বাতায়নের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ জানান, “করোনায় মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই আমরা এ–সংক্রান্ত কল বেশি করে পাচ্ছি, যেটা আগে ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও করোনা বৃদ্ধির কথা বলছে।” এই কল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের উদ্বেগও বাড়ছে।

কিট সংকট ও পরীক্ষা বাধাগ্রস্ত

করোনার সংক্রমণ বেড়ে চললেও রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালগুলোতে নেই প্রয়োজনীয় পরীক্ষা কিট। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোথাও করোনার কিট নেই।

ঢাকা মেডিকেলের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “রোগী এলেও পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। তাই অনেকে হয়তো ভেবেই আসে না।” এই অব্যবস্থার ফলে করোনার প্রকৃত সংক্রমণের চিত্রও অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু জাফর বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, “কিটের সংকট রয়েছে। তা মেটানোর চেষ্টা চলছে। দেশের কিছু স্থানে সংক্রমণ বাড়ছে, তবে তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি।”

নতুন ধরন এক্সএফজি ও এক্সএফসি নিয়ে শঙ্কা

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) জানায়, দেশে করোনার নতুন ধরন XF-GXF-C শনাক্ত হয়েছে, যা অমিক্রনের JN-1 ভ্যারিয়েন্টের উপধরন। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে একজন আক্রান্ত হলেও মে মাসের শেষ সপ্তাহে তা দাঁড়ায় ২৫ জনে। চলতি জুন মাসেও সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।

আইসিডিডিআরবির ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “নতুন এ ধরন নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, তবে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। ভাইরাসের ধরন পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।”

ভারতেও করোনার NB.1.8.1 নামের একটি ধরন দ্রুত ছড়াচ্ছে। গতকাল একদিনে ভারতে ৩৭৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, নতুন এই ধরনটির সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি হলেও তা আগের ধরনগুলোর মতো ভয়াবহ নয়।

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আবু জামিল ফয়সাল মনে করেন, “ভারতের নতুন ধরন বাংলাদেশে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু প্রস্তুতির ক্ষেত্রে দেশে এখনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না, যা উদ্বেগজনক।”

টিকা মজুত অপ্রতুল, মেয়াদোত্তীর্ণের আশঙ্কা

করোনার সংক্রমণ রোধে টিকা কার্যক্রমও কার্যকরভাবে চালু নেই। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (EPI) প্রোগ্রাম ম্যানেজার এ এফ এম শাহাবুদ্দিন খান জানিয়েছেন, বর্তমানে হাতে থাকা ৩১ লাখ ডোজ ফাইজারের টিকার মধ্যে ১৭ লাখ ডোজের মেয়াদ আগস্টের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। বর্তমানে কার্যকরভাবে ব্যবহারের উপযোগী মাত্র ১৪ লাখ টিকা রয়েছে।

তিনি আরও জানান, “গত দুই মাসে এসব টিকা দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়েছে। তবে প্রচারের অভাবে টিকা নিতে মানুষ আগ্রহ দেখাচ্ছে না। প্রচার চালানোর মতো বাজেটও নেই। এই জায়গায় গণমাধ্যমের সহযোগিতা প্রয়োজন।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা শুধুমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী নয়, যাঁদের শেষ টিকা নেওয়ার ছয় মাস পেরিয়ে গেছে, তাদেরও আবার টিকা নেওয়া উচিত। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “বর্তমানে মজুত টিকা সংখ্যায়ও যথেষ্ট নয়। সরকার চাইলে ডব্লিউএইচও বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে টিকা সংগ্রহ করতে পারে।”

তথ্য ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থাপনা

করোনার তথ্য নিয়ে প্রতিদিনের বুলেটিনেও রয়েছে অসংগতি। ১ ও ২ জুনের তথ্য একই বিজ্ঞপ্তিতে পুনঃপ্রকাশ হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ডেস্কে জনবল কমানো হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। ফলে নিয়মিত ও সঠিকভাবে তথ্য উপস্থাপনেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন না করলে পরিস্থিতি মূল্যায়ন সম্ভব নয়। এমনকি রোগ প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

জনসচেতনতা ও প্রচারের অভাব

একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক মনে করছেন, বর্তমানে করোনা প্রতিরোধে যে তৎপরতা থাকা উচিত ছিল, তা নেই। জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা, টিকা সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করা, এবং সংক্রমণের ধরন সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট দেওয়া খুবই জরুরি।

এ ছাড়া গণপরিবহন, বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ জনসমাগমস্থলে মাস্ক ব্যবহারে অনীহা স্পষ্ট। সামাজিক দূরত্ব বা সাবধানতা মেনে চলার প্রবণতা একেবারেই কম। এমন পরিস্থিতিতে একটি নতুন ঢেউ প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন

বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ২২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বৈঠকে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। টিকা মজুত থাকা সত্ত্বেও অনেক কেন্দ্রে কার্যক্রম থমকে আছে।

স্বাস্থ্যনীতি বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত:

  • পরীক্ষা কিট সরবরাহ নিশ্চিত করা,
  • উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিয়ে টিকাদান চালু করা,
  • তথ্যপ্রকাশে স্বচ্ছতা বজায় রাখা,
  • এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের সঙ্গে সমন্বয় করা জরুরি।

করোনাভাইরাস এখনো অতীত হয়ে যায়নি—এটি আবারও প্রমাণিত হচ্ছে দেশে হঠাৎ করে কল বৃদ্ধি, কিট সংকট, এবং টিকা কার্যক্রমে স্থবিরতার মধ্য দিয়ে। নতুন ধরন এবং প্রতিবেশী দেশে সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এখনই করোনা প্রতিরোধে প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। নীতি গ্রহণের পাশাপাশি বাস্তবায়নে গতি না এলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে বলে সতর্ক করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।


তথ্যসূত্র: প্রথম আলো