আলোচিত ও বরখাস্তকৃত পুলিশ কর্মকর্তা ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে ১০০টিরও বেশি খুনের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র প্রার্থী ও বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন। সম্প্রতি ডিবিসি নিউজের একটি টকশোতে অংশ নিয়ে তিনি দাবি করেন, এসব খুন ওসি প্রদীপ একা করেননি—বরং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে ও ‘মাস্টার প্ল্যান’-এর অংশ হিসেবেই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, “ওসি প্রদীপ নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি নিজের ইচ্ছায় কাউকে খুন করেননি। তাকে নির্দেশনা দেওয়া হতো, কাকে, কীভাবে খুন করতে হবে। সেই নির্দেশ আসত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছ থেকে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ঘটনা আমার ১৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনের খুব সামান্য একটি অংশ। আমি যা বললাম, হয়তো অনেকেই তা জানতেন না। কিন্তু ওসি প্রদীপের মুখেই আমি এসব শুনেছি, যখন জেলে ছিলাম। সে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল—তার সঙ্গে কেউ কথা বলে না, কারণ সে বহু খুন করেছে।”
এই আলোচনার সময় ডা. শাহাদাত জানান, তিনি যখন কারাবন্দী ছিলেন, তখন ওসি প্রদীপ ও কেডিএস গ্রুপের কর্ণধার খলিল সাহেবের ছেলে ইয়াসিনের সঙ্গে একই কারাগারের তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি ওয়ার্ডে ছিলেন। তিনি বলেন, “জেলে আমাকে রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে ডিভিশন দেওয়া হয়েছিল। আমি ছিলাম একটি রুমে, অন্য রুমে ইয়াসিন, আরেকটিতে ছিলেন ওসি প্রদীপ।”
জেলজীবনের সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে ডা. শাহাদাত বলেন, “প্রদীপ একদিন আমার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘শাহাদাত ভাই, আমার সঙ্গে কেউ কথা বলে না। একটু কথা বলেন।’ তখন ইয়াসিন বলে উঠল—‘ভাই, তার সঙ্গে কথা বলবেন না, সে খুনি। ১০০টার ওপরে খুন করেছে।’ আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কয়টা খুন করেছো? প্রদীপ বলল, ‘১০০টার মতো হবে।’ এরপর সে জানাল, ‘এই খুনগুলো আমি নিজে করিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে করতে হয়েছে।’”
ডা. শাহাদাত দাবি করেন, “প্রদীপের কর্মকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা ছিল সরকারের একটি সুপরিকল্পিত মাস্টার প্ল্যানের অংশ। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে, বিরোধী কণ্ঠ দমন করতে এমন হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে।”
উল্লেখ্য, আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ২০২০ সালে মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার পর আলোচনায় আসেন। ওই মামলায় প্রদীপসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুলি করে হত্যার অভিযোগ আনা হয় এবং আদালতের রায়ে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। পরে তদন্তে উঠে আসে, প্রদীপ কক্সবাজারে কর্মরত থাকা অবস্থায় বহু ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মানুষ হত্যায় জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ঘুষ, চাঁদাবাজি, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগও ওঠে।
বহু মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াও ওসি প্রদীপের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা হয়েছে এবং তাদের সম্পত্তি জব্দের আদেশ রয়েছে। আদালতের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রদীপের বিরুদ্ধে একাধিক অপরাধের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, যা বর্তমানে বিচারাধীন।
ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, “আজ আমি যে কথাগুলো বললাম, তা হয়তো বহু মানুষ জানতেন না। তবে এটা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার নগ্ন চিত্র। যারা এসব নির্দেশ দিয়েছেন, তাদেরও একদিন জবাবদিহির আওতায় আসতে হবে।”
এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকেই দাবি করছেন, একটি পূর্ণাঙ্গ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি। বিশেষ করে ওসি প্রদীপের খুনের দায় কারা ভাগাভাগি করেছে, সেই প্রশ্নের উত্তর জানাটা এখন জাতির দাবি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, একের পর এক খুনের পেছনে যদি সত্যিই রাজনৈতিক নির্দেশনা থাকে, তবে তা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত। তারা দ্রুত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের স্বতন্ত্র তদন্ত চেয়েছে।
প্রতিবেদনের এক পর্যায়ে ডা. শাহাদাত আরও বলেন, “এই সরকার নিজেরাই খুনের রাজনীতি করেছে। জনগণ জানে না, এই খুনের পেছনে কে কে আছে। আমি আজ বললাম, কাল হয়তো আরও কেউ বলবে।”
তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই বক্তব্যের কোনো প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি।
তথ্যসূত্র:
– ডিবিসি নিউজ লাইভ টকশো (https://youtu.be/2vU1oh8sIsw)
– আদালতের রায় সংক্রান্ত প্রতিবেদন
– দুদকের তদন্ত ও সম্পদ জব্দ নির্দেশ