শুক্রবারের জুম’আর সালাত: ইসলামের মহান সমাবেশ ও এর তাৎপর্য

ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত জুম’আর সালাত। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার মুসলমানদের জন্য এই সালাত একটি বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা ও সম্মিলনের নাম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
“হে ঈমানদারগণ! যখন জুম’আর দিনে নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর। এটি তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পার।” (সূরা জুম’আঃ ৯)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখযোগ্য যে, “فَاسعَوا” (ফাস’আউ) শব্দটির অর্থ এখানে ‘দৌড়ানো’ নয়; বরং সালাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া বোঝানো হয়েছে। ইসলামী হাদীস অনুযায়ী, দৌড়ে গিয়ে নামাজে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নিষেধ রয়েছে। সালাতে যেতে হয় প্রশান্তি, বিনয় ও খুশু-খুযুর সঙ্গে।

জুম’আর নামকরণ ও ইতিহাস

‘জুম’আ’ শব্দটি এসেছে ‘জাম’ বা ‘সমাবেশ’ শব্দমূল থেকে। মুসলমানদের একত্রিত হওয়ার এই দিনের নাম তাই ‘জুম’আর দিন’। ইতিহাস অনুযায়ী, সর্বপ্রথম জুম’আ ফরজ হয় হিজরতের পরে, রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় আগমনের সময়। তিনি কুবা মসজিদ ও মসজিদে নববীর মাঝামাঝি স্থানে ‘বনু সালেম ইবনে আউস’ গোত্রে প্রথম জুম’আর নামাজ আদায় করেন। বর্তমানে ঐ স্থানে ‘মসজিদে জুম’আ’ নামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

জানা যায়, সৌদি আরবের বর্তমান বাহরাইন নয়, বরং পূর্ব অঞ্চলের জুওয়াসা নামক একটি গ্রামেও আবদে কাইস গোত্র প্রথমদিকেই জুম’আর সালাত আদায় করতো।

জুম’আ ও যোহরের মধ্যে পার্থক্য

জুম’আর সালাত ও যোহরের সালাতের মধ্যে রয়েছে কিছু মৌলিক পার্থক্য:

১. যোহর নামাজ ফরজ সকল প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর জন্য, কিন্তু জুম’আ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পুরুষদের জন্য ফরজ।
২. যোহর সালাত মূল সালাত, জুম’আ যোহরের বিকল্প।
৩. জুম’আর কিরাত হয় উচ্চস্বরে, যোহরের কিরাত হয় চুপিসারে।
৪. জুম’আ দুই রাকাত, যোহর চার রাকাত।
৫. জুম’আর আগে খুৎবা আবশ্যক, যোহরের আগে কোনো খুৎবা নেই।

জুম’আর সময় ও মুসুল্লীর সংখ্যা

ইসলামী মত অনুযায়ী, জুম’আ সালাতের সময় যোহরের সালাতের সময়ের সাথেই একত্রে হয়—অর্থাৎ, সূর্য যখন মাঝামাঝি থেকে পশ্চিমে হেলে পড়ে, তখন জুম’আর সময় শুরু হয়।

কতজন হলে জুম’আ আদায় করা যাবে—এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যার সহীহ হাদীস নেই। তবে অধিকাংশ আলেমের মতে, ইমাম ছাড়া কমপক্ষে তিনজন মুসল্লি থাকলে জুম’আ বৈধভাবে আদায় করা সম্ভব। এই মতকে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ) গ্রহণ করেছেন এবং এটিই অধিক গ্রহণযোগ্য।

কোথায় জুম’আ পড়া জায়েয?

ইসলামী শরিয়তে বলা হয়েছে, যত ছোট গ্রামই হোক না কেন, সেখানেও জুম’আ আদায় করা বৈধ। হজরত উমর (রাঃ) বাহরাইনের অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে লিখেন: “তোমরা যেখানে থাক, জুম’আ পড়ো।” এমনকি মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী ছোট জনপদগুলোতেও জুম’আ পড়া হয়েছে এবং সাহাবায়ে কেরাম তাতে কোনো আপত্তি করেননি।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে, অমুসলিম দেশে অবস্থানরত মুসলমানরাও নিজেদের মধ্যে ছোট পরিসরে জুম’আ আয়োজন করতে পারেন। তিনজন মুসল্লি থাকলেও তা আদায় হয়ে যাবে, যদিও মসজিদ না থাকে।

কার উপর জুম’আ ফরজ?

নিম্নোক্ত শর্তগুলো একসঙ্গে পূরণ হলে একজন মুসলিমের উপর জুম’আর সালাত ফরজ হয়:

১. মুসলমান হওয়া
২. প্রাপ্তবয়স্ক (বালেগ) হওয়া
৩. সুস্থ বুদ্ধি ও হুঁশ থাকা
৪. পুরুষ হওয়া
৫. স্বাধীন হওয়া (ক্রীতদাস নয়)
৬. স্থায়ীভাবে অবস্থানরত হওয়া (মুকীম)
৭. শরয়ী ওযর না থাকা (অসুস্থতা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি)

ফরজ না হলেও আদায় করলে সওয়াব পাওয়া যাবে

যাদের উপর জুম’আ ফরজ নয়—যেমন শিশু, নারী, অসুস্থ ব্যক্তি—তারা যদি জুম’আ পড়েন, তাহলে তা আদায় হয়ে যাবে এবং তারা সওয়াবও লাভ করবেন। তবে নারীরা খুৎবা দিতে বা ইমামতি করতে পারবেন না। আর তারা জুম’আ পড়লে যোহর পড়ার প্রয়োজন থাকবে না।

বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয়

১. যদি রাস্তায় কাদা বা দুর্যোগ থাকে এবং কেউ মসজিদে যেতে না পারেন, তাহলে বাসায় যোহরের সালাত আদায় করলেই হবে।
২. যারা শহরের বাইরে বা এমন স্থানে অবস্থান করছেন, যেখানে আজান শুনতে পাওয়া যায় না—তাদের উপর জুম’আ ফরজ নয়, কিন্তু অংশগ্রহণ করলে সওয়াব পাওয়া যাবে।
৩. সফরের সময় জুম’আ পড়া যায়; এমনকি মুসাফির ব্যক্তি খুৎবা দিতে এবং ইমামতি করতেও পারেন।
৪. জুম’আর সালাত হওয়ার আগে সফর করা কিছু আলেমের মতে নিরুৎসাহিত, যদি সেখানে জুম’আ আদায়ের নিশ্চয়তা না থাকে।


উপসংহার

ইসলামে জুম’আ শুধু একটি নামাজই নয়, বরং একটি সাপ্তাহিক শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির সম্মেলন। খুৎবার মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক বার্তা প্রচার হয় এবং মুসলিম সমাজ একত্রিত হয়ে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। তাই মুসলমানদের উচিত জুম’আর গুরুত্ব বোঝা এবং যথাযথভাবে তা আদায় করা।

সূত্র:

  • কুরআন মাজীদ (সূরা জুম’আ)
  • সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম
  • প্রশ্নোত্তরে জুমু’আ ও খুৎবা (লেখক: অধ্যাপক মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম, পরিমার্জনায় ডঃ মনজুরে ইলাহী প্রমুখ)
  • ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন
  • মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা
  • মাজাল্লাতুল বুহুসিল ইসলামিয়া