আজ ১ জুন, বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। বিশ্বের প্রায় ৪০টিরও বেশি দেশে প্রতিবছর এই দিনটিকে ঘটা করে উদযাপন করা হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো দিবসটি পালনের ঘোষণা দেয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য: “Let’s Celebrate the Power of Dairy”, যা দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের বহুমাত্রিক উপকারিতাকে সামনে এনে একটি সময়োপযোগী বার্তা বহন করছে।
বিশ্ব দুগ্ধ দিবস উদযাপনের মূল লক্ষ্য হলো—দুধের পুষ্টিগুণ এবং ডেইরি শিল্পের গুরুত্ব নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি ও উন্নত স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ গঠনে দুগ্ধজাত পণ্যের ভূমিকা তুলে ধরা।
দুধ: প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ খাবার
দুধকে শুধুমাত্র একটি পানীয় বলা ঠিক হবে না, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ আদর্শ খাদ্য। এতে রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ছয়টি খাদ্য উপাদান: পানি, আমিষ, চর্বি, শর্করা, খনিজ পদার্থ এবং ভিটামিন। গাভীর দুধে প্রায় ৮৭.৫% পানি, ৩.৫% আমিষ, ৩.৫% চর্বি, ৪.৮৫% ল্যাকটোজ এবং ০.৬৫% খনিজ পদার্থ থাকে। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন এ, ডি, বি২ ও বি১২-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুধের আমিষ হলো উচ্চমানের প্রোটিন, যার প্রায় ৮০% হলো কেসিন—এই বিশেষ প্রোটিন কেবলমাত্র দুধেই পাওয়া যায়।
শিশুদের জন্য মেধার ভিত্তি গড়ে দুধ
শিশুর জন্মের পর প্রথম ৬-৭ বছরে তাদের মস্তিষ্কের ৯০% বিকাশ সম্পন্ন হয়। এই সময়ে ল্যাকটোজ বা দুগ্ধ শর্করা মস্তিষ্কের কোষের বৃদ্ধি ও কার্যক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। তাই এই সময়ে প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ খাওয়ানো হলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক বিকাশে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই কারণে বলা হয়—“দুধ খাও, বুদ্ধি বাড়াও”।
ঘুম, রক্তচাপ ও হৃদরোগে দুধের ভূমিকা
দুধে থাকা অ্যামিনো এসিড “ট্রিপটোফেন” শরীরে মেলাটোনিন ও সেরোটোনিন তৈরিতে সাহায্য করে, যা ঘুমের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস উষ্ণ দুধ অনিদ্রা দূর করতে পারে। এছাড়াও, দুধে থাকা ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
অনেকে মনে করেন দুধের চর্বি হৃদরোগের জন্য ক্ষতিকর, তবে গবেষণায় দেখা গেছে দুধের ফ্যাটের একটি বড় অংশই হলো আনস্যাচুরেটেড বা উপকারী চর্বি। হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য স্কিমড বা চর্বিমুক্ত দুধ একটি নিরাপদ ও পুষ্টিকর বিকল্প।
অস্থি ও দাঁতের স্বাস্থ্যেও দুধ অনন্য
বয়স্কদের হাড় ক্ষয় (অস্টিওপোরোসিস) এবং দাঁতের ক্ষয় (ক্যারিস) প্রতিরোধে দুধে থাকা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন দুধ পান করলে হাড়ের গঠন মজবুত হয় ও দাঁত থাকে সুস্থ।
ডায়াবেটিস ও দুধ: ভীতি নয়, উপকার
টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তরাও নির্ভয়ে দুধ খেতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক দুধ পান করলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ১৪% পর্যন্ত কমে যেতে পারে। কারণ, দুধে থাকা ল্যাকটোজ ধীরে হজম হয় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়তে দেয় না।
ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স: সমাধান আছে
কিছু মানুষ দুধ হজম করতে পারেন না। এ অবস্থাকে বলে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স। কারণ, তাদের শরীরে ল্যাকটোজ হজমে প্রয়োজনীয় ল্যাকটেজ এনজাইমের ঘাটতি থাকে। তবে নিয়মিত ও ধীরে ধীরে দুধ খাওয়ার অভ্যাস করলে শরীর এই এনজাইম তৈরি করতে পারে। এছাড়া, দই বা ঘোলের মতো ফারমেন্টেড দুগ্ধজাত খাবার সহজে হজম হয় এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকায় শরীরের জন্য বাড়তি উপকার করে।
ডেইরি শিল্পে বাংলাদেশের অগ্রগতি
বাংলাদেশে দুগ্ধ শিল্প উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু দুধের প্রাপ্যতা প্রতিদিন প্রায় ৩৩৫ মিলি, যেখানে WHO এর ন্যূনতম চাহিদা ২৫০ মিলি। দেশে দুধ উৎপাদনের পাশাপাশি দুগ্ধজাত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন ব্যবস্থাও উন্নত হচ্ছে। এই অগ্রগতি দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা এবং কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মেধাবী জাতি গঠনে আন্তর্জাতিক প্রমাণ
দুধের সঙ্গে জাতির মেধার একটি সম্পর্ক রয়েছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সুইজারল্যান্ড ও সুইডেনের জনগণ প্রতিদিন গড়ে ৮২০ থেকে ৯৬০ মিলি দুধ পান করে এবং এসব দেশে প্রতি ১০ মিলিয়নে ৩২-৩৩ জন নোবেল বিজয়ী রয়েছে। তুলনামূলকভাবে যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে দুধ পান কম হলেও নোবেল বিজয়ীর হারও তুলনামূলকভাবে কম। গবেষকরা এই পরিসংখ্যানকে দুধের পুষ্টিগুণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
ভবিষ্যতের পথে: দুধের শক্তিকে কাজে লাগানো জরুরি
প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশে দুধ ও দুগ্ধজাত শিল্পকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে হলে আরও গবেষণা, পুষ্টি-শিক্ষা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দুধভিত্তিক খাদ্যকে স্কুল পর্যায়ে মধ্যাহ্নভোজের অংশ করা যেতে পারে।
দুধ শুধু পুষ্টিকর খাদ্য নয়, বরং এটি একটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমও। বিশ্ব দুগ্ধ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক—“সকলের জন্য নিরাপদ ও পর্যাপ্ত দুধ নিশ্চিত করা”।
লিখেছেন:
প্রফেসর ড. মোঃ নুরুল ইসলাম
প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, ডেইরি সায়েন্স বিভাগ
ডীন, ফ্যাকাল্টি অব অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
ট্রেজারার, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ